ওয়াকফ সম্পত্তি

'ওয়াকফ'-এর আইনগত অর্থ হলো সম্পত্তির মূল বিষয়বস্তুকে বন্ধ করে দিয়ে এর আয়কে কোনো পবিত্র উদ্দেশে উৎসর্গ করা। 'ওয়াকফ'-এর শাব্দিক অর্থ-নিরোধ। ইসলামী শরিয়তে যেসব কাজ বৈধ, উত্তম ও কল্যাণকর বলে বিবেচিত কেবল সেসব উদ্দেশে ওয়াকফ করা যাবে। ইসলাম ধর্মেও যে কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান কর্তৃক ধর্মীয় ও দাতব্য উদ্দেশে চিরতরে সম্পত্তি উৎসর্গ করাকে 'ওয়াকফ' বলে।
ওয়াকফ দুই প্রকার। জনসাধারণের ওয়াকফ এবং ব্যক্তিগত ওয়াকফ। ওয়াকফ করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ওপর মালিকানা বর্তায়। মোতাওয়ালি্ল পরিচালনার অধিকার প্রাপ্ত হয়। কোনো মুসলমান যদি ধর্মীয়, দাতব্য বা পবিত্র উদ্দেশে তার সম্পত্তি চিরস্থায়ীভাবে উৎসর্গ করে নিজের স্বত্ব বিলোপ করে এবং ওই স্বত্ব আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করে তবে ইসলামী আইন অনুযায়ী ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে। যিনি ওয়াকফ করেন তাকে ওয়াকিফ বলে। ওয়াকফ লিখিত দলিল বা মৌখিকভাবে করা যায়। তবে ওয়াকফের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হতে হবে। কোম্পানির শেয়ার, প্রমিসরি নোট কিংবা নগদ অর্থ ওয়াকফ করা যায়। সাবালক ও সুস্থতা সম্পন্ন ব্যক্তি ওয়াকফ করতে পারে।

১৯২৩ সালে ওয়াকফ বৈধকরণের জন্য ওয়াকফ ভ্যালিডিটি আইন জারি করা হয়। ১৯৩৪ সালে বঙ্গীয় ওয়াকফ আইন জারি করে ওয়াকফ সম্পত্তির তদারকি ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। পরে ১৯৬২ সালে ওয়াকফ অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। বর্তমানে এ আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালিত হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়াকফ প্রশাসকের একটি অফিস আছে। পরিচালনা কমিটি গঠন ও ওয়াকফ তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা আছে।
ওয়াকফ দুই প্রকার। ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ এবং ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ। পরকালে শান্তির আশায় পুণ্য অর্জনের উদ্দেশে ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সম্পূর্ণ স্বত্ব দান করা আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করলে তাকে ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ বলে। ওয়াকফ-ই-লিল্লাহর সম্পত্তির আয়ের অর্ধাংশের বেশি সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশে ব্যয় করা হয়। ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত সম্পত্তি। অন্যদিকে কোনো সম্পত্তির মালিক তার সম্পত্তি নির্দিষ্ট অংশ ধর্মীয়, সৎকাজ বা জনহিতকর কাজের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশে দলিলের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি দান করলে তাকে ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ বলে। ওয়াকফ-আল-আওলাদে সম্পত্তির আয়ের অর্ধাংশের কম ধর্মীয় কাজে ব্যয় হয়। বাকি অংশ উত্তরাধিকারীদের কল্যাণে ব্যয় হয়। মোতাওয়ালি্ল ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক।
ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার জন্য যে ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয় তাকে মুতাওয়ালি্ল বলে। মুতাওয়ালি্ল কেবল সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। কোনো সুস্থ সবল ব্যক্তিকে মুতাওয়ালি্ল নিয়োগ করা যায়। ওয়াকিফ ইচ্ছা করলে তার সন্তান-সন্ততি, উত্তরাধিকারী বা অন্য কাউকে মুতাওয়ালি্ল নিয়োগ দিতে পারে।
ওয়াকফকৃত সম্পত্তি কারো নিকট বিক্রয়, হস্তান্তর করা চলে না কিংবা একে হেবা বা মিরাসের (ওয়ারিশি) বিষয়বস্তু করা যায় না। পাঁচ বছরের অধিক সময়ের জন্য ইজারার মাধ্যমে হস্তান্তরও বৈধ হবে না। কেবল প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে মুতাওয়ালি্ল সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ সম্পত্তি অথবা এর কোনো অংশ বিক্রয় করতে, রেহেন দিতে বা বিনিময় করতে পারেন। জনস্বার্থে অথবা ওয়াকিফের পরিবারের স্বার্থে, যে কোনো উদ্দেশ্যেই ওয়াকফ সৃষ্টি হোক না কেন, এ বিধি নিষেধ সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য। মুতাওয়ালি্ল বা রিসিভার ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তরের অনুমতির জন্য প্রশাসকের নিকট আবেদন করলে প্রশাসক যে রকম উপযুক্ত মনে করবেন, সেরূপ তদন্তানুষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের নোটিশ প্রদানের পর, বক্তব্য শ্রবণপূর্বক স্বীয় বিবেচনা মতে যেরূপ শর্ত আরোপ করবেন সেরূপ শর্তে ওই হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারবেন।
ওয়াকিফ স্বয়ং নিজেকেই প্রথম মুতাওয়ালি্ল, আজীবন মুতাওয়ালি্ল নিযুক্ত করতে পারেন, অন্যকেও পারেন। ভবিষ্যৎ মুতাওয়ালি্লর দিকনির্দেশনাও ওয়াকফ দলিলে উল্লেখ করতে পারেন। এ নিয়ে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হলে, এ পদ শূন্য হলে ওয়াকফ প্রশাসক ও আদালত আইনানুযায়ী মুতাওয়ালি্ল নিয়োগ দিতে পারেন।
ওয়াকিফকে ওয়াকফকৃত সম্পত্তির বৈধ মালিক হতে হবে। অর্থাৎ যে সম্পত্তি ওয়াকফ করা হবে তার স্বত্ব-স্বামীত্ব ওয়াকফ করার সময়ে ওয়াকিফের থাকতে হবে। ওয়াকফকালে কোনো ব্যক্তির ওয়াকফকৃত সম্পত্তিটি আদান-প্রদানের ক্ষমতা থাকা চাই। ওয়াকফ যদি উত্তরাধিকারদের প্রতারিত করার উদ্দেশে হয় তাহলে ওই ওয়াকফ কার্যকরী হবে না। তবে ওয়াকিফ যদি ওয়াকফকৃত সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী নাও হয় এবং সে যদি ওয়াকফ করে এবং মালিক কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়, তাহলে ওই ওয়াকফ অবৈধ হবে না। ওয়াকিফ কর্তৃক কোনো সম্পত্তি ক্রয়ের চুক্তি হলেও সে ওই সম্পত্তি ওয়াকফ করতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত সে ওই সম্পত্তি ক্রয় করে। কোনো সম্পত্তির অবিভক্ত অংশ (মুশা) কোনো মসজিদ বা সমাধির অনুকূলে ওয়াকফ করা যায় না। একবার যদি কার্যকরীভাবে ওয়াকফ সম্পাদিত হয় তাহলে তা প্রত্যাহার কিংবা বাতিল করা যাবে না। ওয়াকফ সৃষ্টির জন্য সম্পত্তি নিষ্কণ্টক হতে হবে। মামলার সম্পত্তি বা বিষয়বস্তু ওয়াকফ করা বৈধ নয়।
অছিয়তের মাধ্যমে সৃষ্ট ওয়াকফ ওয়াকিফ তার মৃত্যুর পূর্বে যে কোনো সময় প্রত্যাহার করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ ওয়াকফের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। ওয়াকিফ বা তার সন্তানরা বা তার নিকটাত্মীয় কেউ দরিদ্র ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লে ওয়াকিফ গরিবদের জন্য প্রদত্ত তার ওয়াকফ প্রত্যাহার করতে পারবেন না। প্রত্যেক বছর ১৫ জুলাইয়ের আগে ওয়াকফের প্রত্যেক মুতাওয়ালি্ল একটি সঠিক পূর্ণাঙ্গ হিসাব বিবরণী যথা নিয়মে প্রস্তুত করে প্রশাসকের কাছে দাখিল করবেন। এছাড়া প্রশাসক চাওয়া মাত্র মুতাওয়ালি্ল ওই হিসাব প্রদানে বাধ্য। আদালতও মুতায়াওলি্লকে হিসাব দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন।
অসদাচরণ বা বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে মুতাওয়ালি্ল অযোগ্য প্রমাণিত হলে আদালত তাকে অপসারণ করতে পারেন। মুতাওয়ালি্ল তার দায়িত্ব সঠিক ও যথাযথভাবে পালন করছেন কিনা দেখার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে প্রশাসকের ওপর। মুতাওয়ালি্ল ওয়াকফ অধ্যাদেশের অধীনে আইনসঙ্গতভাবে তার যে কাজ করতে হবে তা করতে ব্যর্থ হন তবে তিনি ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা পর্যন্ত জরিমানা অনাদায়ে ০৬ (ছয়) মাস বিনাশ্রম কারাদ- ভোগ করবেন। কোনো তদন্তের ভিত্তিতে যদি দেখা যায় যে একজন মুতাওয়ালি্লকে অপসারণ করা প্রয়োজন, তবে প্রশাসক তা করতে পারেন। মুতাওয়ালি্ল ওয়াকফকৃত সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে অক্ষমতা অযোগ্য হলে আদালত তাকে অপসারণ করে ওয়াকিফের পরিবারের কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে মুতাওয়ালি্ল নিয়োগ দিতে পারেন। মুতাওয়ালি্ল ফাসিক (পাপাচারী) হয়ে গেলেও আদালত তাকে অপসারণ করতে পারেন।
১৯৮৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১৫০৫৯৩টি ওয়াকফ স্টেট আছে। তার মধ্যে ৯৭০৪৬টি রেজিস্ট্রিকৃত, ৪৫৬০৭টি মৌখিক ৭৯৪০টি ব্যবহারিক। বাংলাদেশে মোট ২১৪৫৭৫.৪৬ একর ওয়াকফ সম্পত্তি আছে তার মধ্যে ২০০৮৪১.০৭ একর কৃষি জমি ও ১৩৭৩৪.৩৯ একর অকৃষি জমি। সামপ্রতিক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৪০০ ওয়াকফ সম্পত্তি ওয়াকফ প্রশাসকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের আয় হতে মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, কবরস্থান, এতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ধর্মীয় উৎসব পরিচালিত হয়ে আসছে। ওয়াকফ প্রশাসন বর্তমানে ১৫০০ মসজিদ, ৭০০ মাদ্রাসা, ১০০ এতিমখানা, ৫টি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং নওমসুলিমদের জন্য কল্যাণ তহবিল পরিচালনা করছে।

 

সহকারী কমিশনার (ভূমি)


নোটিস বোর্ড